
তাপদগ্ধ কোর্ট প্রাঙ্গণ। গিজ গিজ করছে লোকজন। সূর্য আজ এমন তীর্যক রশ্মি ছুঁড়ছে যে গনগনে তাওয়ার মতো উত্তপ্ত পৃথিবী! বাতাস যেন মরুর লূ-হাওয়া!
আটতলা সহকারী জজ আদালত ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে সুমনার গলা শুকিয়ে গেল। একটা মাত্র লিফট। সেখানে সারাক্ষণই জট পাকিয়ে আছে ভিড়। লম্বা লাইন গেট ছাড়িয়ে বাইরে গিয়ে ঠেকেছে!
এ গরমে পারতপক্ষে কেউ সিঁড়ি ভাঙতে নারাজ! কিন্তু সুমনার দেরী করলে চলবে না। দ্রুত সাততলায় যেতে হবে! স্বয়ংক্রিয় সেই মেশিনে চড়ার আশা জলাঞ্জলি দিয়ে অগত্যা নিজের পা দুখানাকেই ভরসা করে সপ্তম সহকারী জজ আদালতের দিকে ছোটে।
সেখান থেকে আরো কয়েকটি কোর্টে যেতে হবে। সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে উঠতে নামতে কলজে শুকিয়ে গেল।
একনাগাড়ে কয়েকটি কোর্টে পিটিশান, হাজিরা দাখিল ইত্যাদি সকালের রুটিন কাজ শেষ করে সুমনা কিছুটা দম নেয়ার সুযোগ পায়।
কোর্ট ওঠার পর আবার দৌড়াতে হবে! ঘামে সারা শরীর ভিজে জবজব করছে। অতিরিক্ত গরমে সবার অবস্থাই কাহিল। একটু বিশ্রাম না নিলেই নয়! তাড়াতাড়ি চেম্বারের দিকে যায় সুমনা। মেট্রোপলিটনের চারতলার সিঁড়ির পর সিঁড়ি অতিক্রমে সুমনার অসাড় লাগে! কোনোমতে চেম্বারে গিয়ে ঢোকে!
সেখানেও বিপত্তি! বিদ্যুৎ নেই! চক্কর দিয়ে উঠল মাথাটা। উহ! আল্লাহ! আজ একি শুরু হল! এখন এখানে বসা আর হাবিয়া দোজখে থাকা এক কথা! চরম বিরক্তি নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে আসে সুমনা। আবার চারতলা থেকে নিচে নামতে হলো। কী আর করা! দায়রাজজ আদালতের সামনের খোলা চত্বরেই যাওয়া যাক।
চত্বর জুড়ে বড় বড় ক’টি গাছ মাথার উপর ছাতার মতো সবুজ ডালপালা বিছিয়ে দিয়েছে। যত গরমের দিনই হোক-এই একটি জায়গায় একটু প্রশান্তি মেলে। পুরো চত্ত্বরটা ঠাণ্ডা ছায়ায় ঘেরা। সারা দেশ থেকে আসা নানান ধরনের মানুষদের অশান্ত হৃদয়ে একটু হলেও স্নিগ্ধ পরশ বুলিয়ে দেয়।
বিচার প্রার্থী লোকের ভিড় এখানে লেগেই থাকে। ঝালমুড়ি ওয়ালা, পেঁপে বিক্রেতা, বাদাম ওয়ালা, চা বিক্রির দোকান, বই বিক্রেতারা পশরা মেলে বসেছে। দায়রা জজের সামনে একটা গেট, আগে এটি খোলা থাকতো এখন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বন্ধ গেটের সামনে দুটো সিঁড়ির খাঁজ রয়েছে। ওই জায়গা টুকুতে ডাবের টুকরি নিয়ে বসে পড়েছে জবির মিয়া। তার আনা ডাবের পানি খুব মিষ্টি। প্রায় সবাই জবির মিয়ার কাছ থেকেই ডাব কেনে।
গরমে তৃষ্ণায় প্রথমে ডাবের কথাই মনে হল সুমনার। এতক্ষণে সব শেষ হয়ে গেছে কিনা কে জানে! প্রায় দৌড়াতে থাকে সে। পরিচিত অনেক ক’টি মুখের সঙ্গে চোখাচোখি হল- কিন্তু সুমনার তাড়া দেখে যে যার পথে গেল। দূর থেকে নজর করে দেখলো নাহ! এখনো তো ঝুড়ি ভর্তিই দেখা যাচ্ছে! মুহূর্তে মনটা প্রসন্ন হয়ে উঠল। জবির মিয়া চালু লোক। ব্যবসার কাটতির সময়ে চালান বাড়িয়ে দিয়েছে।
সবে সকাল ১১টা। বিদ্যুৎ না আসলে আজ ভোগান্তির অন্ত থাকবে না। তৃপ্তিভরা মিষ্টি ঠাণ্ডা পানি দুর করে দিল সব ক্লান্তি। শান বাঁধানো গাছের তলায় বসে কথা বলছে আমেনা আর স্বাতী, সুমনার সহকর্মী। কাজের ফাঁকে একদণ্ড বিশ্রাম। সুমনাও এগিয়ে গিয়ে তাদের সাথে যোগ দেয়।
ঠিক সে সময়েই একজন বয়স্ক মহিলা সামনে এসে দাঁড়ায়। বোঝা যায় কোর্টের কাজেই এসেছেন। সাধারণ মানুষ বিপদে না পড়লে সহজে আসে না কোর্টে। কত ধরনের বিপদ যে মানুষের হতে পারে এখানে না আসলে বোঝা যায় না।
মানুষটির ভাঙাচোরা বিষণ্ন মুখ। বয়সের চেয়ে আঁকা-বাঁকা রেখায় কষ্টের ছাপই বেশি। কোটরাগত দুচোখে দীপ্ত দৃষ্টি। সামনে পাকা চুলের মাাথায় ঘোমটা দেয়া। পরনে আধ-ময়লা পুরনো ছাপা শাড়ি। হাতে একটা পুঁটুলি। তাতে পলিথিন জড়ানো কাগজ দেখা যাচ্ছে।
সুমনার সঙ্গীদের চোখে মুখে ফুটে ওঠে অনীহা। এ ধরনের হত দরিদ্র মানুষদের কেসে কারও আগ্রহ থাকে না। তারা দুজন বিদায় জানিয়ে চলে যায় চেম্বারের দিকে। কিন্তু সুমনা মহিলাটিকে এড়তে পারে না। আহা! মুখ দেখেই বোঝা যায় ভারবাহী জীবন তার উপর কতনা ধকল চাপিয়ে ফিরছে!
সে আগন্তুকের দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল- ‘কিছু বলবেন’? মহিলা যেন একথারই অপেক্ষায় ছিল! তড়বড়িয়ে কী যেন বলে উঠল সুমনা পুরোপুরি বুঝল না। তাই আবার জিজ্ঞেস করলো-
-‘কী সমস্যা আপনার’?
অমনি যেন কলের মুখ খুলে দিল, কলকলিয়ে উঠলেন মহিলা-
-‘সমস্যা ত এড্ডা”! হ্যার লগে যোগ অইছে হাজারডা! অনেক কতা কওনের আছে। তাইলে আপনে বুইজবেন মোর কুন দোষ আছে কি নাই’!
সুমনা মনে মনে প্রমাদ গোনে। তবু উঠে দাঁড়ায়। বলে-
-‘আচ্ছা, আসেন। বসে নিয়ে শুনবো আপনার কথা’। মেট্রোপলিটনের চারতলায় নিজস্ব চেম্বারে না গিয়ে সাময়িকভাবে তৈরী আইনজীবী সমিতির ছাপড়ার অফিস ঘরের দিকে যায়। মহিলাটিও পিছু পিছু আসে। ভেতরে সারি সারি বেঞ্চির একটিতে বসে মহিলাকে বসায় মুখোমুখি।
তিনি খুব আগ্রহের সঙ্গে পুঁটুলি খুলে একতাড়া কাগজ বের করে সুমনার দিকে এগিয়ে দেন। দোমড়ানো হলদেটে কাগজগুলো বহুদিনের বহুপুরনোর পরিচয় বহন করছে। বিভিন্ন মামলার আরজি, লিখিত সুপারিশ, অনুরোধ, এ ছাড়া আরও অনেক কাগজ। আধা মুছে যাওয়া অস্পষ্ট ফটোকপি। দীর্ঘদিন ভাঁজরত অবস্থায় থাকার ফলে সেগুলোর ভাঁজে ভাঁজে গভীর দাগ-ক্লিষ্ট। অনেক ক’টি লাইনে লাইনে কাগজ ছিঁড়ে যাওয়ায় পড়ার অযোগ্য।
নাম তার বিবি মতি বানু। বয়স বাষট্রি। একখণ্ড জমি নিয়ে বিরোধ। জমির পরিমাণ ২০ শতক। বিবি মতিবানুর প্রতিপক্ষ একই গ্রামের কফিলউদ্দিন। একই জমি তারা দুজনেই মালিক বলে একে অপরের বিরুদ্ধে লড়ছেন। সে দুষ্টচরিত্রের লোক। তার শক্তি অনেক। কফিলউদ্দিন জোর করে জমি দখলে নিয়েছে বলে মতি বানুর অভিযোগ। প্রচণ্ড রাগ ও ঘৃণায় শরীর মুখ কুঁচকে তীব্র ক্রোধে ফুঁসে ওঠে মতিবানু-
-‘শয়তানের শয়তান!! হগলতেরে টাকা গেলায়’!
কফিলউদ্দিনের বিরুদ্ধে বিচার চেয়ে ১৭ বছর ধরে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন মতিবানু।
বিবি মতিবানুর মুখ কাগজের চেয়ে সরব। কফিলউদ্দিন আগে কিছুই করতে না, ইদানিং কব্জির জোর বেড়েছে। মতিবানুর ভাষায়-
-বাদাইম্যা ব্যাডা। কিচু করে না। এহন নাহি ‘রাংনীতি’ করে! ওই হক্কুইন্যা খবিছ মোর ভিডা দখল করতে ছায়! মুই ত অরে ছাড়ুমই না যম্মের দুয়ার তক নিয়া ছাড়ুম অরে!
অবিরাম কথা বলছেন মতিবানু আর মাঝে মাঝে প্রতিপক্ষের উদ্দেশে অভিশাপ বর্ষণ করছেন। দীর্ঘদিনের বিরোধে কফিলউদ্দিন তার বিরুদ্ধে কয়েকটি মামলা করেছে। একটি মামলার বয়স অন্তত ১৫/১৬ বৎসর। কফিলউদ্দিনের অভিযোগ এরকম, -‘তাহারা দাঙ্গা- হাঙ্গামাকারী, অন্যের সম্পদ লুণ্ঠনকারী। তাহারা প্রচলিত আইন-কানুন, সালিশ কিছুই মানে না। তাহারা দস্যু প্রকৃতির ও ভয়ংকর চরিত্রের লোক বটে। তাহারা লোকজন নিয়ে অস্ত্র সস্ত্রে সজ্জিত হয়ে আমাকে বাঁধিয়া আমার ঘরের মালামাল সব জোর পূর্বক ছিনাইয়া লইয়া যায়’!
মামলায় পঁচজন আসামির মধ্যে মতিবানূর স্বামী নুরুন্নবীর নাম এক নম্বরে এবং মতিবানুর নাম দুই নম্বরে। মতিবানূ মুখ বিকৃত করে বলেন-
-‘হার্মাইদ্যার ঘরের হার্মাইদ্যা! বেবাক মিত্যা কতা’!
অপর পক্ষের করা আরেকটি মামলায় বরগুনার আমলী আদালত মতিবানুকে বেকসুর খালাস দিয়েছেন। কাগজে দেখা যায় মতিবানু আমতলী উপজেলার পৌরসভা চেয়ারম্যান, ইউএনও, সাংবাদিক, গ্রাম সালিশ থেকে শুরু করে সকলের দুয়ারেই ধর্না দিয়েছে। অনেকের স্বাক্ষরিত চিঠি রয়েছে তার ঝুলিতে, বিবাদের সুরাহা করার জন্য অনুরোধের চিঠিও আছে।
গত বছর মতিবানুর জমির পুকুরের মাছ ধরে বিক্রি করে ফেলে কফিলউদ্দিন। মতিবানু কোর্ট পর্যন্ত দৌড়ায়। বাদী মতিবানু বিবাদী কফিলদ্দিন কর্তৃক তার শান্তিপূর্ণ ভোগদখলে বিঘ্ন ঘটানোর বিরুদ্ধে একটি ইনজাংশন জারী চেয়েছেন।
কয়েক মাস আগে কফিলউদ্দিন তার জমির গাছ কেটে নিয়ে যায়। মতিবানু তার বিরুদ্ধে গ্রাম আদালতে নালিশ করে। সেখানে কফিলউদ্দিনকেই দোষী বলা হয়েছে।
তবু কফিলউদ্দিনকে কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না। কী শক্তির বলে কফিলউদ্দিন বহুবিদ রায়ের পরেও মতিবানুর জমির ওপর হামলা চালায়! সমাজ, আদালতও কি তার মত অসহায় কি না, একথা মাঝে মাঝে মতিবানুর মনে মাছের ঘাইয়ের মতো উঁকি দেয়।
গ্রাম আদালতে দোষী সাব্যস্ত কফিলউদ্দিনকে কঠিন শাস্তি দেয়া দরকার। আদালতের ডিক্রি অনুযায়ী এ অসহায় মহিলার জমি উদ্ধার ও তাকে শান্তিপূর্ণ বসবাসের সুযোগ করে দেয়া দরকার।
কিন্তু কে করবে? -প্রশাসন?, আদালত? গ্রাম সালিশ? সবাই তো ‘শক্তের ভক্ত নরমের যম’! সর্বোচ্চ আদালদের আদেশ কেন বহাল হচ্ছে না? কফিলউদ্দিন এত অন্যায় করার পর আরও অন্যায় করার সাহস পায় কোথা থেকে? কোন অদৃশ্য শক্তি তাকে শাস্তি পেতে দিচ্ছে না?
সুমনা বলল-‘আপনি এখন কী চান’?
-‘ওই কফিলউদ্দিন এক কুড়ি বচছর ধইরা হয়রানি করতাছে। জবর দখল কইরা জমির ধান উপড়াইয়া নিয়া যায়। হ্যায় আমাগো বিরদ্ধে পাঁচ ছ’ডা মামলা করছে। আদালত সবুগলার রায় মোগোরে দেছে। হ্যারপরও জমি আমাগো ভাগ্যে নাই’!
-বলতে বলতে মতিবানু হু হু করে কেঁদে ওঠেন। চরম হাহাকারে বুক ভেঙে একটা নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে। একটু পরই চোখের পানি মুছে সিধা হয়ে বসেন। কুঞ্চিত মুখগহব্বর ভেদ করে দৃঢ়-প্রতিজ্ঞ এক কঠিন কন্ঠস্বর শোনা যায়-
-‘মুই ঐয়্যার বিচার চাই’!
সুমনা মতিবানুর রেখা সংকুল মুখের দিকে তাকাল। নিজ অধিকার আদায়ে সংকল্পবদ্ধ অবয়ব। প্রাণ ধারণের কঠিন সংগ্রামের উপর বিষফোঁড়ের মত এত এত উটকো ঝামেলায় জারেজার! তবু লড়াকু জীবন সৈনিক লড়ে যাচ্ছেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে।
দেশের আইন আদালতের মারপ্যাঁচের জালে অষ্টেপৃষ্টে বাঁধা পড়ে কি হয়রানীই না হতে হচ্ছে মতিবানুকে। খেয়ে না খেয়ে মামলার পেছনে নিঃশেষ হচ্ছেন। অথচ স্থানীয় গ্রাম-সালিশ ইচ্ছে করলে খুব সহজেই সমাধান দিতে পারে। কিন্তু দুর্নীতি পরায়ন সমাজে ন্যায় বিচার পাওয়া, সামাজিক সুবিচার পাওয়া সুদূর পরাহত।
বয়সের ভারে ন্যুব্জ, জীর্ণশীর্ণ দুর্বল মতিবানু কি অদৃশ্য শক্তির এতগুলো দুর্গ ভেঙে কোনোদিন নিজ অধিকার আদায় করতে পারবে?
আজকালের খবর/আরইউ