প্রকাশ: শনিবার, ১৯ আগস্ট, ২০২৩, ৩:১৭ PM

ড. হুমায়ুন আজাদ। কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক, সমালোচক, উপন্যাসিক, তথা প্রথাবিরোধী লেখক। পাঠকেরা তার লেখার মাধ্যমে চেনেন তিনি কেমন লেখক ছিলেন, ছিলেন কেমন মানুষ। লেখার বাইরে পরিবারের কাছে কেমন ছিলেন, কেমন ছিলেন অন্দরের এই মানুষটি তা জানতে তার মেয়ে মৌলী আজাদের লেখা ‘হুমায়ুন আজাদ আমার বাবা’ বইটি অনন্য। এই বইয়ের মাধ্যমে মাধ্যমে চেনা যায় বাবা হুমাযুন আজাদকে, স্বামী হুমাযুন আজাদকে। জানা যায় রাড়িখালের জন্য বুকের মধ্যে অকৃত্রিম ভালোবাসা জমিয়ে রাখা প্রকৃতিপ্রেমী হুমাযুন আজাদকে।
ড. হুমায়ুন আজাদ বহুমাত্রিক জ্যোতির্ময়। হুমাযুন আজাদ একটি নাম, একটি ইতিহাস। নানা বাড়ি কামারগাঁয়ে জন্ম হলেও বেড়ে উঠেছিলেন নিজ বাড়ি মুন্সীগঞ্জের রাড়িখাল গ্রামে। ৪০ বছর ঢাকায় বসবাস করলেও তার হৃদয়জুড়ে থাকত ১৫ বছর থাকা রাড়িখাল গ্রাম। আজীবন মনে রেখেছেন রাড়িখালের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বিষ্ণুপদ স্যার আর হোসেন মাস্টারকে। নগর জীবনের বাসিন্দা হয়েও প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠতেন সকাল ৬-৮টার মধ্যে, আবার ঘুমাতেন রাত ১০টার মধ্যে। ইলিশ মাছ ভাজা আর করল্লা ভাজি ছিল প্রিয় খাবার যা মাঝে মধ্যে নিজেই রান্না করতেন কেউ বাসায় না থাকলে। অভিভাবক হিসেবে ছিলেন দায়িত্বশীল। মাঝে মাঝে পরিবারের সবাইকে নিয়ে হোটেল শেরাটনের বুফেতে খাইয়ে সারপ্রাইজ দিতেন।
হুমায়ুন আজাদ যেমন ছিলেন কাউকে তোয়াক্কা না করা লোক, আবার অন্যদিকে ছিলেন বড় অভিমানী। তার কিছু কবিতা পড়লে তাকে যেমন ক্ষুব্ধ কবি বলে মনে হয় আবার তার প্রেমের কবিতা পড়লে তাকে ভালোবাসায় ন্যুব্জ কবি বলে মনে হয়। সমাজ সংসারের ভঙ্গুরতাকে ফুটিয়ে তুলতেন উপন্যাসে, আবার মাত্রাতিরিক্ত ‘সেক্স’ও থাকত তার উপন্যাসে। নারীবাদী এই লেখকের নারীদের সম্পর্কে বক্তব্য ছিল, নারী নয়, মানুষ হয়ে বেড়ে উঠ। প্রথাবিরোধী এই লেখক লেখালেখির স্বার্থে নিজের পিতৃপ্রদত্ত নাম হুমাযুন কবির থেকে হয়েছিলেন হুমায়ুন আজাদ। মৌলবাদবিরোধী এই লেখকের আজীবনের স্বপ্ন ছিল সবুজ সুন্দর ধর্মীয় গোঁড়ামিমুক্ত একটি বাংলাদেশ। তিনি চাইতেন গণতান্ত্রিক পরিবর্তন।
হুমায়ুন আজাদের প্রিয় একটি খাবার ছিল মোটা সর তোলা দুধে মাখানো ভাত। ফেব্রুয়ারি মাস ছিল হুমায়ুন আজাদের আনন্দের সময়। কোনো উৎসবেও তিনি এত আনন্দিত হতেন না বইমেলার সময় যতটা হতেন। সন্তানরা যখন কোলের শিশু তখনো তাদের নিয়ে হুমায়ুন আজাদ বইমেলায় যেতেন সঙ্গিনীসহ। কিন্তু ২০০৪ সালে সে বইমেলা থেকে ফিরবার পথেই তার ওপর এসেছে সবচেয়ে বড় আঘাত। মৌলবাদীদের সে আঘাত ছিল চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়ার আঘাত। সে আঘাতই একদিন তাকে চিরতরে ঘুম পাড়িয়ে দেয় জার্মানির হোটেল রুমে অবশেষে। বইমেলা থেকে আহত হয়ে সিএমএইচে বেড়ে যখন প্রাণের স্পন্দন ফিরে পান, তখন প্রথমেই বলছিলেন আমি বইমেলায় যাব।
বইমেলায় আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা নিয়ে বই লেখার ইচ্ছা প্রকাশ করছিলেন তার দুই মেয়ের কাছে। বইয়ের নামও ঠিক করেছিলেন, ‘মৃত্যু থেকে এক সেকেন্ড দূরে’। কিন্তু সে বই তিনি লিখে যেতে পারেননি। এরপরও বিভিন্ন সময় তাকে মৃত্যুর হুমকি দেওয়া হয়েছিল। তার পরিবারকে হুমকি দিয়েছিল, তার ছেলে অনন্যকে অপহরণের চেষ্টা করা হয়েছিল। পরিবারের ওপর যখন হুমকি এসেছিল তখন তিনি সত্যিই বিচলিত হয়েছিলেন। পরিবারকে খুব গুরুত্ব দিতেন। লেখালেখির বাইরে বেশিরভাগ সময় দিতেন পরিবারের সদস্যদের। হুমকি আর সকল অশান্তি ও পরিবারের মঙ্গলের জন্য পাড়ি জমিয়েছিলেন ক্ষণিকের জন্য সূদূর জার্মানিতে। কিন্তু জার্মানিতে গিয়েও নিরাপদ থাকতে পারেননি। ১৫ আগস্ট পৃথিবী থেকে বিদায় নেন এই প্রথাবিরোধী শক্তিমান লেখক। কিন্তু হোটেল রুমে তার মৃত্যু রহস্য অজানাই রয়ে গেল। মৃত্যুর পরেও একটি গোষ্ঠী হুমায়ুন আজাদের জানাজা বাংলার মাটিতে করতে না দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল। শেষ শয্যায় শায়িত হলেন হুমায়ুন আজাদ তার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা নিজ গ্রাম রাড়িখালে।
আজকালের খবর/আরইউ