রবিবার ৫ মে ২০২৪
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে ‘হিটস্ট্রোক’
মোতাহার হোসেন
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ৭:১৯ PM
বৈশাখের শুরুতেই তীব্র দাবদাহে ছটফট করছে মানুষ এবং প্রাণীকুল। দিন দিন সূর্যের আগুন ঝরানো পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে ‘হিটস্ট্রোকে’ রূপ নিচ্ছে। এ অবস্থা বিরাজ করবে মে মাস অব্দি। গরম থেকে স্বস্তি পেতে  মানুষ, পশু ও প্রাণিকুল ছুটছে ছায়া, কিছুটা ঠান্ডা বাতাসের  খোঁজে। টানা দু’সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে রাজধানীসহ দেশের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে মৃদু থেকে মাঝারি মাত্রার তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। ইট, বালি, সিমেন্টে নির্মিত প্রাচীর ঘেরা রাজধানীর এই চিত্র ক্রমশ গ্রাস করছে দেশের উত্তরাঞ্চলের অধিকাংশ জেলাসহ দেশের অন্যত্রও। আবহাওয়া অফিস সূত্র বলছে রংপুর, রাজশাহী, চূড়াডাঙ্গা, ঢাকা, ময়মনসিংহ, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের উপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। 

উত্তরাঞ্চলের কোথাও কোথাও তাপমাত্রা ৪৩ ডিগ্রি অতিক্রম করেছে। চলমান মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ পরবর্তী কয়েকদিন অব্যাহত থাকবে পারে এবং তাপমাত্রা আরো বৃদ্ধি পেতে পারে। জলীয় বাষ্পের আধিক্যের কারণে বাড়তে পারে অস্বস্তিও। গত কয়েক দিনে অনেকের মৃত্যু হয়েছে। এমনি অবস্থায় আবহাওয়া অধিদফতর দেশব্যাপী ‘হিট অ্যালার্ট’ জারি করেছে। এবং বিনা প্রয়োজনে মানুষকে ঘর থেকে বের না হওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে। আর জরুরি প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হতে হলে ছাতা নিয়ে বের হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে।

মূলত জলবায়ু পরিবর্তনজণিত বিরূপ প্রভাব এবং বাতাসে কার্বন নিঃসরন বৃদ্ধি পাওয়ায় উত্তপ্ত হচ্ছে বায়ুমণ্ডল, উত্তপ্ত হচ্ছে ভূপৃষ্টও। এ কারণে দেশব্যাপী ‘হিটস্টোক’ পরিস্থিতি বিরাজ করছে বলে মনে করেন পরিবেশ ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, ঢাকা সহ সারাদেশে সবুজ বলয়, বন, বৃক্ষ, মুক্তজলাশয় কমে যাওয়ায় পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। তদুপরি তাপদাহ থেকে রক্ষা পেতে যানবাহনে, বাসা, অফিস, আদালত, ব্যাংক পাড়ায়, শিল্প কারখানায় এসির অতিরিক্ত ব্যবাহারে ‘উত্তপ্ত উনুনে ঘি ঢেলে’ দেওয়ার মতো অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।  আবহাওয়াবিদদের ভাষ্য হচ্ছে দেশব্যাপী এই তাপদাহের মধ্যেও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মাঝে মধ্যে ঝড়, বৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়ের তান্ডব থাকবে স্বল্প সময়ের জন্য। এ পরিস্থিতি বিরাজ করবে মধ্য জুন অব্দি- এমন আভাস দিয়েছেন আবহাওয়াবিদরা। রাজধানীতে যে তাপমাত্রা, তা ছিল চলতি বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। তবে কয়েকদিন ধরে টানা তাপ প্রবাহের মধ্যে বৈশাখের তৃতীয় দিন এক পশলা বৃষ্টিতে খানিকটা স্বস্তি এনেছে নগর জীবনে। তবে এই স্বস্তি সাময়িক। পরে ফের গরমের অস্বস্তিতে মানুষ। তীব্র গরমে বিপাকে পড়েছেন খেটে খাওয়া মানুষ। বাইরে কড়া রোদ থেকে বাঁচতে অনেকে গাছের ছায়ায় আশ্রয় নিচ্ছেন। কেউ আবার লেবুর শরবত খেয়ে স্বস্তির সন্ধান করছেন।

এমনি অবস্থায় বিরূপ জলবায়ু মোকাবিলায় সক্ষমতা বৃদ্ধি সময়ের দাবি এবং জনপ্রত্যাশা হলেও এ জন্য অধিক মাত্রায় মুক্ত জলাশয়, গাছ-পালা, বন সৃজন এসির ব্যবহার কমিয়ে আনা পাহাড়, প্রকৃতি, নদ-নদীকে স্বাভাবিক অবস্থানে রাখা নিশ্চিত করার কার্যকর উদ্যোগ নেই। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, প্রকৃতির নিজস্ব রীতি-নীতি আছে। প্রকৃতির ওপর মানুষের নিষ্ঠুর থাবা, বন বৃক্ষ ধ্বংস, পাহাড় কর্তন, মুক্তজলাশয় ধ্বংস অব্যাহত থাকায় প্রকৃতির এনন প্রতিশোধ নেয় প্রায়শই। এর মধ্যে পাহাড় ধস, ভূমি ধস প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। সময়ের বিবর্তনে পৃথিবী বহু পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বর্তমানে উপনীত। প্রায় সাড়ে চারশ কোটি বছরের পুরনো পৃথিবীতে মানুষের বসবাস মাত্র আড়াই লাখ বছর। তার পর মানুষ বুদ্ধির জোরে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যমে এই গ্রহে মানুষই একমাত্র প্রাণী বসবাসের উপযোগী করে তুলেছে। 

পাশাপাশি মানুষ যখন থেকে ভোগ বিলাস আরাম আয়েশের প্রতি ঝুঁকছে ঠিক তখন থেকে ধীরে ধীরে শিল্প যুগের সূচনা হয়। একই সঙ্গে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউজ গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। অবশ্য মানুষ যতটা প্রযুক্তিনির্ভর, শিল্পনির্ভর, অধিক মাত্রায় ভোগবাদি, অধিক মাত্রায় বিলাসী জীবনে অভ্যস্থ হচ্ছে ততটাই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বায়ুমন্ডলে গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরনের পরিমাণ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বায়ুমণ্ডলে গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরনের পরিমাণ বাড়তে থাকায় প্রকৃতিও বিরূপ আচরণ শুরু করেছে। বিশেষ করে ২০২১ সালের প্রারম্ভ থেকে সমগ্র বিশ্বের আবহাওয়া হয়ে ওঠেছে  টালমাটাল। এই মুহূর্তে বিশ্বের বহু দেশের মানুষকে ভয়ংকর দাবদাহে পুড়তে হচ্ছে, আবার বিশ্বের কোথাও কোথাও আবার ঝড় জলোচ্ছ্বাস,  অতিরিক্ত বন্যা ও  ভারি তুষারপাত, অতিরিক্ত দাবানলে পুড়ছে। বিশ্বব্যাপী আবহাওয়ার এমন বৈরী আচরণ মূলত বেশীর ভাগই  মনুষ্যসৃষ্ট। ২০২৩ সাল ছিল পৃথিবীর ইতিহাসের ছিল সর্বাধিক উষ্ণতম বছর। 

চলতি বছরের উষ্ণতা গত বছরকেও ছাড়িয়ে যাবে এমন আশঙ্কা আবহাওয়াবিদদের। বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি জেলায় ইতোমধ্যে থার্মোমিটারের পারদ ওঠেছে  সর্বোচ্চ ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে। প্রচণ্ড দাবদাহে সমগ্র দেশের জনজীবন অতিষ্ঠ। এসব হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ ফল। শিল্পায়নের শুরু হতে মানুষ জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড ও মিথেনের ভারসাম্য নষ্ট করছে, উত্তপ্ত করছে বায়ুমণ্ডলকে। কার্বন ডাই-অক্সাইড ও মিথেনের মতো গ্রিনহাউজ গ্যাস পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে সূর্যের উত্তাপকে বাধাগ্রস্ত করে। সেই উত্তাপ আবার বিশ্বের সকল জায়গায় সমানভাবে ছড়িয়ে পড়ছে না,  পরিনামে  আবহাওয়া এমন অস্বাভাবিক ও রুদ্ধ মূর্তি ধারণ করছে। সময়ে অসময়ে দেখা যাচ্ছে বন্যা, অনাবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস প্রভৃতি।

বিগত কয়েক বছরে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাংলাদেশেও বেশ কয়েক বার আঘাত হেনেছে। আবহাওয়াবিদদের আশঙ্কা আগামী বছরগুলোতে সমগ্র বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশে দেশেও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মারাত্মক রূপ ধারণ করবে। এই মুহূর্তে অতিরিক্ত দাবদাহে দেশের মানুষ আক্রান্ত। ঝড়ের সময় তাপমাত্রা কিছুটা কমিয়া আসলেও অন্যান্য ভোগান্তি বাড়ে বহু গুণে। কালবৈশাখী কিংবা অতিবৃষ্টির কারণে সৃষ্ট বন্যার সময়  রাজধানীসহ বিভিন্ন উপকূলীয় অঞ্চল পানিতে তলিয়ে যায়। এই মুহূর্তে আমাদের ওপর এই বৈরী আবহাওয়ার প্রভাব কমিয়ে আনাই শুধু চ্যালেঞ্জ। এ পরিস্থিতির সঙ্গে মানুষকে  কীভাবে খাপ খাইয়ে নেওয়া যায় তার পদ্ধতি রপ্ত করতে হবে। পাশাপাশি ক্রমশ জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে বেশি বেশি বৃক্ষ রোপণ, মুক্ত জলাশয় সৃষ্টি করে তপ্ত পৃথিবীকে বাঁচিয়ে রাখা ও মানুষের স্বস্থির উপায় হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

অন্যদিকে বিশ্ববাসির জন্য আরেকটি আশঙ্কার কথা হচ্ছে বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধ এবং এই শতকের শুরু হতে দক্ষিণ গোলার্ধের হিমবাহগুলি ক্রমবর্ধমান হারে গলতে শুরু করে। বিশেষত, গত দশকের মাঝামাঝি হতে এই গতি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। হিমশীতল অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশ এবং হিমালয়ের বরফ গলা অব্যাহত  থাকায় বিশ^বাসির জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পৃথিবীর দক্ষিণ মেরুর তাপমাত্রার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি সমগ্র বিশ্বের জন্যই বড় ধরনের হুমকিস্বরূপ। দক্ষিণ মেরুর বরফঢাকা পূর্বাঞ্চলের মালভূমিতে অবস্থিত কনকর্ডিয়া গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা বলেছেন, ২০২২ সালের ১৮ মার্চ এই অঞ্চলের তাপমাত্রা মৌসুমি গড় তাপমাত্রার চেয়ে ৩৮ দশমিক পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যায়। আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা  ‘বিশ্বের সবচেয়ে হিমশীতল জায়গার তাপমাত্রায় এমন  পরিবর্তন যথেষ্ট উদ্বেগের বলেছেন।’ অ্যান্টার্কটিকার বরফ গলতে থাকায় চারপাশে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে ক্রমশ। অ্যান্টার্কটিকার এই পরিবর্তন পুরো মানবসভ্যতার জন্য মহাবিপদ ডেকে আনছে। জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের কারণে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের জনজীবন বিপদাপন্ন হয়ে ওঠছে। প্রচণ্ড দাবদাহের কারণে অনেক দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হচ্ছে। দীর্ঘ খরার অভিঘাতে কৃষিপণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রেও সংকট দেখা দিচ্ছে। এমনি অবস্থায় প্রকৃতি, পরিবেশ সংরক্ষণ, অধিক হারে বনায়ন, বৃক্ষাচ্ছাদন, মুক্তজলাশয়, জলাধার গড়ে তোলা এবং জীবাশ্ম জ¦ালানীর ব্যাবহার কমিয়ে আনা হলে প্রকৃতির এই বৈরী আচরণ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যেতে পারে। এ নিয়ে এখন থেকেই কাজ শুরু করা দরকার।

লেখক : সাংবাদিক, সাধারণ সম্পাদক-বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম।

আজকালের খবর/আরইউ








সর্বশেষ সংবাদ
ভোট কেন্দ্রে প্রভাব বিস্তার করলে ফৌজদারি অপরাধে মামলা: ডিসি গাজীপুর
শেখ হাসিনা, পঙ্কিল রাজনীতির পথ অতিক্রম
স্মার্ট টিমের পক্ষ নেওয়ায় আক্রমণের শিকার বেসিসের সাবেক সভাপতি
ফেনী জেলা পুলিশের মাসিক কল্যাণ সভা
কিশোরগঞ্জে কোল্ড স্টোরেজে মিলল ২৮ লাখ ডিম, দ্রুত খালাসের নির্দেশ
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
দেশের চার বিভাগে বড় ঝড়ের আশঙ্কা, দুই নম্বর সংকেত
জগন্নাথপুরে পানি উন্নয়ন বোর্ডের এসও’র বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ
বজ্রপাতে বসতঘরে আগুন, মা-ছেলের মৃত্যু
বিএনপির হাঁক-ডাকে জনগণের কোনো আগ্রহ নেই: কাদের
প্রধানমন্ত্রীকে নৌকাখচিত চেয়ার উপহার দিতে চান মাধবপুরের হিরু
Follow Us
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : গোলাম মোস্তফা || সম্পাদক : ফারুক আহমেদ তালুকদার
সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : হাউস নং ৩৯ (৫ম তলা), রোড নং ১৭/এ, ব্লক: ই, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮-০২-৪৮৮১১৮৩১-৪, বিজ্ঞাপন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৯, সার্কুলেশন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৮, ই-মেইল : বার্তা বিভাগ- [email protected] বিজ্ঞাপন- [email protected]
কপিরাইট © আজকালের খবর সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft