প্রকাশ: সোমবার, ১৫ এপ্রিল, ২০২৪, ৮:০৪ PM
হালখাতা ফারসি শব্দ। ফারসিতে হাল মানে নতুন। পয়লা বৈশাখের দিন ধর্ম, ভাষা নির্বিশেষে নতুন খাতা খোলার সময়। সময়ের বিবর্তনে এই রীতির সঙ্গে জুড়েছে মিষ্টিমুখ। বাঙালির যে কোনো শুভ কাজ এমনিতেই মিষ্টিমুখ ছাড়া সম্পূর্ণ হয় না। তবে ইতিহাস যাই বলুক, হালখাতা মানেই রকমারি মিষ্টিভরা বাক্স আর সঙ্গে বিচিত্র সব ছবি দিয়ে সজ্জিত বাংলা ক্যালেন্ডার। সময় বদলেছে। প্রজন্ম পাল্টেছে। ক্রমশ ডিজিটাল হচ্ছে সবকিছু। বাঙালি বাড়ির দেওয়ালে এখন আর বাংলা ক্যালেন্ডার ঝুলতে দেখা যায় না। পয়লা বৈশাখের উদ্যাপন রমরমিয়ে চললেও এই দিনটির সঙ্গে যে সংস্কৃতি আর ঐতিহ্য জড়িয়ে আছে, সেটাও অনেকটাই বিস্মৃত। হালখাতা আবহমান বাংলার চিরায়ত সংস্কৃতি। বাঙালির সঙ্গে বাংলা ভাষার যেমন সম্পর্ক, পয়লা বৈশাখের সঙ্গেও হালখাতার তেমনই নাড়ির টান।
আকবরের আমলের কর আদায়ের একটি ক্যালেন্ডারেই পয়লা বৈশাখ নিয়ে জাঁকজমক শুরু। বাঙালির নতুন বছর সেই তারিখ পঞ্জিরই উদ্যাপন। হালখাতার সঙ্গেও তেমনই এক ইতিহাস জড়িয়ে আছে। বর্তমান সময়ে প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বাংলা সনের প্রথম দিনে বিয়ানীবাজারের দোকানের হিসাব আনুষ্ঠানিক হালনাগাদের এ প্রক্রিয়ায় ভাটা পড়েছে। এক সময়ে বছর শুরুর দিন ভোরে দোকানপাট ধুঁয়ে, সোনা-রুপার পানি ও গোলাপ জল ছিটানো হতো। চৈত্রের মাঝামাঝি থেকেই বকেয়া রয়েছে এমন ক্রেতাদের কাছে হালখাতার দাওয়াত কার্ড পাঠানো হতো। এছাড়া লাল কাপড়ে মোড়ানো বা বাঁধাই করা মোটা খাতাটিই একসময় ক্রেতার সঙ্গে বিক্রেতার ব্যবসায়িক সম্পর্কের যোগসূত্র স্থাপন করতো। তবে এ সময়ে অত্যাধুনিক প্রযুক্তিপণ্য কম্পিউটার দখল করে নিয়েছে এ খাতার জায়গা।
আগে বছরের প্রথম দিন নতুন খাতা খোলার জন্য হালখাতার আয়োজন ছিলো উৎসব। উৎসবে মিষ্টিমুখ করানো হতো ক্রেতাদের। এখন ঐতিহ্য মেনে কোথাও কোথাও হালখাতা হয়। কিন্তু ক্রেতারা আগের মতো সাড়া দেন না। কেউ ব্যাংকে কিংবা বিকাশে টাকা পাঠিয়ে দেন। উৎসব হয় না আগের মতো।
কম্পিউটার ব্যবসায়ী মাহবুবুর রহমান সুমন বলেন, বর্তমানে প্রায় সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেই কম্পিউটার রয়েছে। খাতার কাজ এখন কম্পিউটারই করছে। আগে বিভিন্ন পণ্য বিক্রির জন্য ক্রেতাদের হাতে লেখা টালি (স্লিপ) দেওয়া হতো। এখন কম্পিউটারাইজড স্লিপ দেওয়া হয়। ফলে খাতা রাখার খুব একটা প্রয়োজন হয় না। সময়ের পরিবর্তনে হালখাতা উৎসবটি হারিয়েছে এর গুরুত্ব।
পুস্তক ব্যবসায়ী আব্দুল কাদির বলেন, আগে হালখাতা আনন্দ উৎসবে যার যার সাধ্য মতো কার্ড ছাপানো। ব্যাপক পরিসরে উৎসব আনন্দে হালখাতা পালন করা হতো। বর্তমানে চাকরিজীবী থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী প্রায় সবাই ইংরেজি মাসের ওপর ভিত্তি করে আয় ব্যয় করেন। নগদ বিক্রি অথবা বাকি লেনদেন সবই হয় ইংরেজি মাসের ওপর ভিত্তি করে। তাই ধীরে ধীরে পয়লা বৈশাখে হালখাতা প্রথা হারিয়ে যাচ্ছে।
পৌরশহরের ব্যবসায়ী আলী আহমদ কুনু মিয়া জানান, বর্তমানে চিরচেনা হাতে লেখা খাতার ব্যবহার বেশি একটা দেখা যায় না। দোকানে কম্পিউটার বা মোবাইলের মাধ্যমে পণ্য বেচাকেনার হিসাব রাখা হচ্ছে। ফলে ক্যাশিয়ারের পাশে থাকা চিরচেনা লাল কাপড় কিংবা কাগজে মোড়ানো হিসাবের হালখাতার বইটিও চোখে পড়ে না তেমন।
বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্যর এই প্রাণের হালখাতা উৎসব যেন আজ আধুনিক যুগের অনলাইন ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তির পৃথিবীর কাছে ধোপে টিকতে পারছে না।
আজকালের খবর/ওআর