
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর গত বৃহস্পতিবার (২১ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত ১১৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে। অধিক বৃষ্টিপাতের ফলে ঢাকার নানা স্থানে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। জলাবদ্ধতার সমস্যা শুধু ঢাকাবাসীদের জন্য নয়, অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে এটি চট্টগ্রামসহ সারা দেশের বড় বড় মেট্রোপলিটন শহরেও ইদানিং উদ্বেগজনকভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যদিও সামান্য বৃষ্টিতেই ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরে জলাবদ্ধতার সমস্যা প্রকট আকারে দৃশ্যমান হয় এবং গণমাধ্যম ফলাও করে প্রচার করা হয়। রাজধানীবাসী আবারো মারাত্মক জলাবদ্ধতার মুখোমুখি হয়েছে, অবিরাম বৃষ্টিপাতে রাজধানীর বিভিন্ন অংশ ও প্রধান সড়কগুলি ডুবে যাওয়ার দৃশ্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। মূলত রাজধানীর বৃষ্টির পানি ঢাকা ওয়াসার খাল এবং নর্দমার লাইনের মাধ্যমে নদীতে পৌঁছানোর কথা থাকলেও একদিকে নর্দমার পানি বাঁধা প্রাপ্ত হচ্ছে এবং অন্যদিকে খালগুলি অবৈধভাবে দখলের কবলে চলে যাচ্ছে। ফলে ভারী বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতা ঢাকাবাসীর নিত্যদিনের সঙ্গী এবং যাতায়াতের পথে জীবন্ত মরণফাঁদ। এ কারণে প্রায়শই রিকশা, ভ্যান, সিএনজি, প্রাইভেট কার অতিরিক্ত জলাবদ্ধতার মধ্যে ম্যানহোলের গর্তে পড়ে নানা ধরনের অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনা ঘটছে।
রাজধানী ঢাকা বিশ্বের অন্যতম জনবহুল মেগা সিটি। ঢাকা মহানগরের জনসংখ্যা অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়ছে ফলে শহরটি তাদের অভ্যন্তরীণ সংস্থান এবং ব্যবস্থাপনার সীমাবদ্ধতার কারণে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নাগরিক সুবিধা মোকাবেলা করতে হিমশিম খাচ্ছে। ফলে জলাবদ্ধতার মতো হাজারো সমস্যা নাগরিক জীবনকে বিষিয়ে তুলছে। দিনে মশা রাতে মাছি, এ নিয়ে ঢাকায় আছি- এটি ঢাকাবাসীর পুরানো দিনের প্রবাদ। ঠিক তেমনিভাবে বৃষ্টির সময় জলাবদ্ধতা আর অন্যসময় যানজট ঢাকাবাসীর নিত্য দুর্ভোগের সাথী। এ থেকে যেন নিস্তার নেই, দিনকে দিন এ সমস্যা আরো প্রকট হচ্ছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ঢাকা শহরে বর্ষার সময় (মে থেকে অক্টোবর) পানি দূষণ, যানজট, বায়ু ও শব্দদূষণ, বর্জ্য নিষ্কাশন, কালো ধোঁয়া ইত্যাদির মতো জলাবদ্ধতাও সাধারণ ও নিয়মিত সমস্যা হিসাবে দেখা দিয়েছে। এই জলাবদ্ধতা ঢাকা শহরে যদিও মুষলধারে ঝড় বৃষ্টিপাতের কারণে ঘটে এবং এ কারণে বেশ কয়েক দিন ধরে রাস্তাঘাট ডুবে থাকে। তবে সঠিক পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকা এবং অদক্ষ ব্যবস্থাপনার কারণে এমনটি হয়ে থাকে। আসলে ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন অংশে অবস্থানকারী বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার কর্তা ব্যক্তিদের খামখেয়ালি, সমন্বয়হীনতা, অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত এবং সঠিক পরিকল্পনার অভাবে এ জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানারসের (বিআইপি) এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বিগত নয় বছরে ঢাকার মহানগর ও এর আশেপাশে কমপক্ষে তিন হাজার ৪৮৩ একর জলাশয় এবং নিম্নভূমি ভরাট হয়েছে এবং ২০১০ সালে প্রণীত বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) নিয়মনীতি উপেক্ষা করে ঢাকার ৩৬ শতাংশ জলাশয় ও নিম্নাঞ্চল ভরাট করা হয়েছে। তারা আরও বলছে, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) আওতাধীন নগরীর বিভিন্ন অংশে নয় বছর আগে এক লাখ ৯৩৭ একর জলাশয় এবং নিম্নভূমি ছিল, কিন্তু ইতোমধ্যে এর মধ্যে ২২ শতাংশ অর্থাৎ ২২ হাজার ১৫৬ একর ভরাট করা হয়েছে, যা প্রতিবছর জলাবদ্ধতা ইস্যুতে ব্যাপক অবদান রাখছে।
বর্ষাকালে ঢাকা শহরে ভারী বর্ষণ হয়, কারণ এটি গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের বিস্তৃত প্লাবনভূমিতে অবস্থিত। কিন্তু অপরিকল্পিত নগর উন্নয়ন কার্যক্রম এবং দ্রুত জনসংখ্যার বৃদ্ধির কারণে জলাধারগুলিতে এবং প্রাকৃতিক পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার সামান্য হেরফের বা কোন যত্ন না থাকায় প্রাকৃতিক পয়ঃনিষ্কাশন পথগুলিতে নগরীর জলপ্রবাহ সঠিকভাবে প্রবাহিত হতে পারে না এবং এ কারণে সেসব জায়গায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। তাই শহরের বিভিন্ন অংশ বেশ কয়েক দিন ধরে জলাবদ্ধ হয়ে থাকায় সংশ্লিষ্ট এলাকাটিকে সম্পূর্ণ অচল করে দিচ্ছে। অপর্যাপ্ত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, স্বল্প ধারণক্ষমতা এবং অগভীর সেকেলে ড্রেন ব্যবস্থা, প্রাকৃতিক পলিমাটি, খোলামেলা পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, ত্রুটিপূর্ণ পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, বিদ্যমান পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাব এবং ড্রেন ও পয়ঃনিষ্কাশন পথগুলিতে বর্জ্যরে স্তুপ অপসারণ না করা ইত্যাদি জলাবদ্ধতায় বাধার প্রধান কারণগুলির জন্য দায়ী। এ ছাড়া, মৌসুমী জোয়ারের প্রভাব এবং শহর অঞ্চলের ভৌগলিক অবস্থানও জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে।
ঢাকার পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, পানির পাম্প, খাল এবং নদীগুলি মোট সাতটি সরকারি সংস্থা দ্বারা পরিচালিত হয়- বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), ঢাকা জেলা প্রশাসন, ঢাকা পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ (ঢাকা ওয়াসা), ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) এবং ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি)। রাজধানীর বিভিন্ন অঞ্চলে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য প্রতিটি সংস্থা পৃথকভাবে কাজ করে কিন্তু কারো সঙ্গে কারো সমন্বয়, পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন ও সহযোগিতার লেশমাত্র নেই। এসব সংস্থা নিজেদের মধ্যে সমন্বয় করে কার্য সমাধান করলে যেকোনো সমস্যা অনেকটা সহনীয় মাত্রায় চলে আসার কথা কিন্তু অপরিকল্পিতভাবে যে যার মতো কাজ করার ফলে জলাবদ্ধতার সমস্যা দূর হচ্ছে না।
ঢাকা ওয়াসা পানির ড্রেন সিস্টেমে কাজ করে যা ভূপৃষ্ঠের পানিকে পরিচালনা করে। অনিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, রক্ষণাবেক্ষণ এবং নগরবাসীর সচেতনতার অভাবে ঢাকার বেশিরভাগ ড্রেনগুলি ভারী বর্জ্য এবং প্লাস্টিকের আবর্জনায় আবদ্ধ। এই জলাবদ্ধতা ঢাকা শহরের বাসিন্দাদের জন্য বিরাট বোঝা এবং বৈরী সামাজিক, শারীরিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত প্রভাব তৈরি করে। ট্রাফিক চলাচল এবং স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত করে, স্থাপত্য এবং অবকাঠামোর ক্ষতি করে, গাছপালা এবং জলজ প্রাণীর বাসস্থান ধ্বংস করে, মানুষের আয় রোজগারের ক্ষতি করে এবং নগরবাসীর জীবনে জলাবদ্ধতা নানাভাবে প্রভাবিত করে। বৃষ্টির পানি দূষিত হয়ে যায় কারণ এটি ভারী বর্জ্য, ক্লিনিকাল বর্জ্য, পলি, দূষক, গার্হস্থ্য বর্জ্য এবং অন্যান্য মানবিক ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে মিশ্রিত হয় যা পানিবাহিত রোগগুলিকে বাড়িয়ে তোলে। আবদ্ধ বৃষ্টির পানির ফলে রোগ জীবাণুর বংশবৃদ্ধির ক্ষেত্র তৈরি হয় যা স্বাস্থ্যের জন্য চরম ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং অস্বাস্থ্যকর ও দুর্গন্ধযুক্ত হয়ে থাকে।
নির্মম সত্য হচ্ছে ঢাকা শহরজুড়ে ৬৫টি প্রাকৃতিক খাল ছিল, কিন্তু বর্তমানে এ সংখ্যা মাত্র ২৬, কারণ তাদের বেশিরভাগই আবর্জনায় ভরপুর ও অবৈধ দখলদারদের দখলে। নগরটি এমনভাবে পরিকল্পনা করা হয়েছে যাতে পানি ব্যবস্থাপনার কোনো পরিকল্পিত সংযোগ বিবেচনা করা হয়নি। বর্তমানে এর কোনো সুষ্ঠু ও যথাযথ কোনো স্বল্পমেয়াদী প্রতিকারও নেই। এ মেগা-সিটিতে উচ্চ জনসংখ্যার ঘনত্বের কারণে প্রাকৃতিক সংযোগগুলো ইতোমধ্যে অবরুদ্ধ হয়ে উঠেছে এবং এটিকে একটি কংক্রিট জঙ্গলে পরিণত করা হয়েছে। এখন এটি প্রথমে সমস্ত বিদ্যমান জলাশয়ের কার্যকারিতা উন্নত করতে হবে এবং তারপরে কালবিলম্ব না করে সমস্ত খাল অবৈধ দখলকারীদের কাছ থেকে পুনরুদ্ধার করতে হবে এবং এগুলোর সংযোগ পুনরায় প্রতিস্থাপন করতে হবে, যাতে শহর থেকে পানি প্রবাহ সঠিকভাবে নিষ্কাশন করতে সহায়তা করে।
ঢাকা সিটি কর্পোরেশন উভয়ই বলেছিল অবৈধভাবে দখলকৃত সিটি খালগুলি ঢাকা বাঁচাতে পুনরুদ্ধার করা হবে, কারণ খালগুলি ব্লক করা জলাবদ্ধতার জন্য দায়ী। ইতোমধ্যে কিছু খাল পুনরুদ্ধার করা হয়েছে কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়। ঢাকায় ১২ শতাংশ জলাধার থাকার কথা ছিল যা এখন মাত্র তিন শতাংশ। সমস্ত পুকুর এবং জলাশয় ভরাট করা হয়েছে। অপরিকল্পিত নগরায়নও সমস্যা সৃষ্টি করেছে, কারণ ঢাকার মোট ৪০০ বর্গকিলোমিটার এলাকার মধ্যে ৩৩০ বর্গকিলোমিটার ইতোমধ্যে ঘরবাড়ি, জলের প্রবাহের পথে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এখন সমস্যার ক্ষেত্রগুলি যদি সঠিকভাবে চিহ্নিত করে সমাধানের পথ খোঁজা হয়, তবে সঠিক সমাধান খুব কঠিন নয়। মূল সমস্যাটি হলো বক্স কালভার্টগুলির যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে পানি খুব ধীরে ধীরে প্রবাহিত হয়-সম্ভবত স্বাভাবিক প্রবাহের গতিতে পাঁচ থেকে ১০ শতাংশ হতে পারে। সরেজমিনে দেখা গেছে, বেশিরভাগ সিটি খাল অবৈধভাবে ঢাকা ওয়াসার দখলে চলে গেছে এবং বাকি খালিগুলো নিয়মিত পরিষ্কারও হয় না। জলাবদ্ধতা মোকাবেলার জন্য জনসেবা সংস্থাগুলির সক্ষমতা বৃদ্ধি, সমন্বয় এবং জনসচেতনতা বাড়াতে প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিতে হবে।
বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ নগরে বসবাস করলেও বাংলাদেশে শহরবাসীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। তবে দিন দিন এই শহরে আগমনকারী জনসংখ্যা উদ্বেগজনকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে কিন্তু সে হারে পরিকল্পিত নাগরিক সুবিধা বাড়ছে না। অধিক জনসংখ্যা এবং অপরিকল্পিত নগরায়ণ পদ্ধতির জন্য পুরো নগর জীবনে নেমে আসছে নানা ধরনের নেতিবাচক প্রভাব। যেমন- পরিবেশ দূষণ, বাসস্থান ও খাদ্যের অভাব, পরিবহন সংকট, যানবাহন সংকট ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র অভাব, বৃষ্টির সময় জলাবদ্ধতা দেখা দেয়া। বাংলাদেশের অনেক শহরের পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা মোটেও সন্তোষজনক নয় এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সঠিক নিয়মকানুন মেনে না চলার জন্য বিভিন্ন ধরনের পরিবেশ বিপর্যয় ঘটছে।
জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধি এবং অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কারণে অনেক বড় বড় শহরের সুষ্ঠু পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা বর্তমানে সংশ্লিষ্ট নগর কর্তৃপক্ষের জন্য একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ। সুতরাং স্থায়ী জলাবদ্ধতা দূর করার জন্য পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার কার্যকর পরিচালনা এবং টেকসই ব্যবস্থাপনার জন্য সংশ্লিষ্ট নগর কর্তৃপক্ষ এবং সেবাদানকারী সংস্থাগুলির মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ, পরিকল্পনা প্রণয়ন, সমন্বয় এবং সরকারি ও বেসরকারি খাতের মধ্যে সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন।
জিল্লুর রহমান : ব্যাংবার ও কলাম লেখক।
আজকালের খবর/আরইউ