বুধবার ২৯ নভেম্বর ২০২৩
কাঁচের পৃথিবী
সুলেখা আক্তার শান্তা
প্রকাশ: শনিবার, ২৬ আগস্ট, ২০২৩, ৩:১৪ PM
মানিক আর তুহিন দুই বন্ধু। গলায় গলায় ভাব। একে অপরের কাঁধে হাত দিয়ে হাঁটে। যেখানে যাবে একসঙ্গে যাবে। মানিক বলে, বন্ধু তুই আমাকে ছাড়া থাকতে পারিস না আমিও তোকে ছাড়া থাকতে পারি না। তার চেয়ে এক কাজ কর, তুই আমাদের বাড়ি থেকে যা। তুহিন একটু ভেবে বলে, না বন্ধু দূরে আছি তাই ভালো। একসঙ্গে না থাকাই ভালো। এমনি তুই আমার পড়ালেখার খরচপাতি দিস তার ওপর তোর বাড়িতে গিয়ে বসবাস করার দরকার নেই। দুই বন্ধুর আলাপ শুনে মানিকের বাবা রাজিব হোসেন বলেন, বাবাজি থেকে যাওনা তোমার বন্ধু যখন বলছে। তা ছাড়া তোমার বাড়িও অনেক দূর, সেখান থেকে আসা-যাওয়া তোমার তো কষ্টও হয়। রাজিব হোসেনের এমন কথা শুনে তুহিন না বলতে পারে না। সে মানিকদের বাড়িতে থাকতে রাজি হয়। মানিকের বাবা খুশি হয়। বন্ধু তুই বাড়ি গিয়ে কাপড়চোপড় নিয়ে আয়। ঠিক আছে বন্ধু আমি গেলাম কাপড়চোপড় নিয়ে আসি। তুহিনের বাবা-মা অবস্থাপন্ন না হলেও এটি চায় না ছেলে অন্যের বাড়িতে গিয়ে থাক। ফয়সাল আহমেদ ছেলে তুহিনকে বলেন, বাবা আমরা গরিব হলেও নিজের যা আছে তা নিয়েই থাকা ভালো। বাবা আমি ওইখানে থাকতে চাইনি। কিন্তু মানিকের বাবা থাকার জন্য আমাকে অনেক করে বলেছে। ঠিক আছে বাবা তোর যা ভালো মনে হয়। মানিক তার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে চলে আসে তুহিনদের বাড়ি। তুহিন মানিককে বলে, ভালো লাগছে আজ থেকে তুই আর আমি কোথায় গেলে একসঙ্গে এক বাড়িতে ফিরে আসবো। ভাগাভাগি করে আলাদা হতে হবে না।
জলি খুব তিরিক্ষি মেজাজের মানুষ। তার বিয়ে হওয়ার পর স্বামীর বাড়ি একবার গিয়েছিল পরে আর যায়নি। এরপর থেকে ভাইয়ের সংসারেই থাকেন। ভাইয়ের ছেলে তুহিন মেয়ে হেনা আর টুম্পাকে নিজের সন্তান মনে করেন। হেনা জলিকে মা বলে ডাকে। হেনা মুখে জলিও মা ডাক শুনতে চায়। জলি মায়ের মতো করে হেনা সব তত্ত্বাবধান করেন। হেনা বলে, এখন তো আমি বড় হয়েছি। নিজের সবকিছু গুছিয়ে করতে পারি। তারপরও তুমি সব কাজ করে দাও কেন? জলি হেনার থুতনি ধরে আদর করে বলেন, একটুখানি পুচকে মেয়ে সে এখন বড় হয়েছে। সে আবার নিজের সব কাজ করতে পারে, বাবা কি সাংঘাতিক কথা!
জলি তুহিনকে বলেন, শোনো বাবা তোমার যখন যা লাগে বলবা কোনো লজ্জা, শরম করো না। ঠিক আছে ফুপু। ওই মানিকের মার আশায় থাকবা না আমাকে বলবা। টুম্পা এর মধ্যে কান্নাকাটি করে, ভাইয়ের বউ রেশমাকে ধমক মারে, কী হয়েছে মেয়ে কাঁদে কেন? জলি সব সময় কথা বলেন ধমকের কণ্ঠে। দাও মেয়েকে আমার কোলে দাও। তোমার দ্বারা কী হবে না হবে বুঝতে পারছি। রেশমা হাসে জলির কথা শুনে। তোমার ভাতিজিকে তুমি কোলে নাও। টুম্পাকে গোসল করিয়ে খাওয়ান। দেখছো বাচ্চাটা এখন কান্নাকাটি করছে? বাচ্চাদের যত্ন জানতে হয়! রেশমা আশ্বস্ত হয়ে বলেন, আপনি আছেন বলেই তো সবকিছুতে একটু নিশ্চিন্ত থাকতে পারি।
হেনার অলক্ষে তুহিন তাকে অনুসরণ করে। যেদিকে যায় আড়াল আবডালে তাকে দেখে। বিষয়টি হেনার দৃষ্টি এড়ায় না। একদিন তুহিনকে জিজ্ঞেস করে, আপনি আমাকে আড়াল থেকে দেখেন কেন? তুহিন ব্যাপারটা হালকা করতে হেঁসে বলে, না কই? তুহিনের মনে বিষয়টি ঘুরপাক খেতে থাকে। হেনাকে কেন তার এত আপন মনে হয়। কেন তার জন্য এত মায়া লাগে। ওকে এত দেখেও কেন মন ভরে না। মনে হয় সারাক্ষণ ও যেন আমার সামনে থাকে। কাউকে এ কথা বলতেও পারে না। আর মানিক জানলে কী বলবে! সেই ছোট্টবেলা থেকে চোখের সামনে বেড়ে উঠছে। আমার মনের মধ্যে ওর জন্য যেমন করে, তেমন তো ওর করে না।
হেনাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য ঘটকের সঙ্গে কথা বলে হেনার বাবা রাজিব হোসেন। ঘটক মজিবর উৎফুল্ল হয়ে বলেন, আপনার মেয়ের জন্য পাত্র অভাব হবে না। আপনার যেমন নাম ডাক তেমন আপনি অবস্থাপন্য। আপনার মেয়ের জন্য পাত্রের অভাব হবে না। হেনার জন্য পাত্র নিয়ে তেমন খোঁজাখুঁজি করতে হয় না, প্রথম পাত্র দেখাতেই বিয়ে ঠিক হয়ে যায়। মোড়ল বাড়ির বিয়ে যে সেই কথা! আনন্দ উৎসব চলে কয়েক দিন ধরে। উৎসবের বাড়িতে পাওয়া যায় না তুহিনকে। বাড়ির আনাচে কানাচে অলক্ষে গিয়ে বসে থাকে। মানিক খুঁজতে যায়, পেয়ে, কিরে তোর কি হয়েছে?
কই কিছু নাতো।
তোকে যে দেখাই যায় না।
কই, সবার মাঝেই তো আছি।
বিয়ে বাড়ি এত এত মানুষ এত আনন্দ করছে। আর তুই কিনা এখানে ওখানে বসে থাকিস। এটা হলো? চল বাড়ি চল। তুহিনের হৃদয় যে বেদনার ঝড় বইছে সেটা তুহিন ছাড়া কেউ জানে না। তুহিন ভালোবাসে হেনাকে। মানিক তার এত ঘনিষ্ঠ বন্ধু সেও কখনো টের পায়নি।
জলি বলেন, কিরে তুহিন বিয়ের আনন্দ-উৎসব করো, মনমরা হয়ে আছো কেন? তোমরা অল্প বয়সি নাচবা, গান গাইবা, হৈ হুল্লর করবা। এগুলো কি তোমাদের বলে দিতে হবে? এক কলস পানি নিয়ে জলি তুহিনের গায়ে ঢেলে দেন। নেও এবার নাচো, লাফালাফি করে উঠানের মাটি উঠিয়ে ফেলো। গায়ে হলুদের দিন হেনার গায়ে হলুদ কাপড়। তুহিনের দীর্ঘশ্বাস। এই হলুদ শাড়ি পরা মানুষটি আর কোনোদিন তার হওয়ার নয়। এত আয়োজন প্রস্তুতি অন্য একজনের হওয়ার জন্য। বর অহিদ বিয়ে করে নিয়ে যায় হেনাকে। তুহিন মনে করে, এই বাড়িতে হেনা নেই তাই বাড়িতে কোনো আনন্দ নেই। সে আর এখানে থাকবে না। ব্যাগ গুছিয়ে মানিককে জানায়, আমি চলে যাচ্ছি।
কেন? কোথায় যাবি?
বাড়ি চলে যাচ্ছি।
তোকে কেউ কিছু বলেছে?
না।
তাহলে যাবি কেন?
ভালো লাগছে না, তাই।
তোর কোন কিছুর আগা মাথা পাই না। যেতে হবে না তুই এখানে থাকবি। কেউ কিছু বলে থাকলে তুই আমাকে বল?
তোকে তো বললাম আমাকে কেউ কিছু বলেনি।
বাবা-মার কাছে বল তুই চলে যাচ্ছিস।
স্বার্থপরের মতো আমি কাউকে কিছু না বলে চলে যাচ্ছি। আমার হয়ে তুই বলে দিস। তুহিন চলে যায়।
বিয়ের পর হেনা ফিরানীতে বাবার বাড়ি আসে জামাই নিয়ে। বাড়িতে হেনা সবাইকে দেখতে পেলেও তুহিনকে দেখতে পায় না। জলির কাছে জিজ্ঞেস করে, মা তুহিন কই? জলি বলেন, সে কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে চলে গেছে। এরপর থেকে হেনার মন ছটফট করতে থাকে। সে এখন তুহিনকে না দেখে থাকতে পারছে না। তুহিনকে কোথায় পাওয়া যাবে সেই খোঁজ করে। খোঁজে খোঁজে তুহিনের বাড়ি যায়। তুহিনকে বলে, তুমি আমাদের বাড়ি থেকে চলে এসেছো কেন?
এমনি।
তোমাকে না পেয়ে আমার খুব খারাপ লাগছে। এখন আমার আমাদের বাড়িতে থাকতে ইচ্ছা করছে না।
না তোমার এভাবে বের হওয়া ঠিক হয়নি। তোমার বর তোমাকে না পেলে কী ভাববে বলতো?  
সে ভাবনা কি তোমার আছে? তাহলে তো তুমি আমাদের বাড়িই থাকতে। আমি তোমাদের বাড়ি থাকা না থাকায় তাতে তোমার কী আসে যায়?
তাতে অনেক কিছু আসে যায়। এই যে তুমি নেই আমি বাধ্য হয়ে বাড়িতে কাউকে কিছু না বলে চলে এসেছি।
ঠিক আছে, দেরি করা ঠিক হবে না। এখন চলো তোমাকে দিয়ে আসি। তুমি এখন থেকে আমাদের বাড়িই থাকবে।
একথা বলো না। যেখানে মানিককে ছাড়া আর কাউকে কিছু বলে আসিনি সেখানে আমি যাই কী করে! আর সত্যি বলতে কি হেনা, যেখানে তুমি নেই সেখানে আমি থাকতে পারবো না। তুমি আমাকে যদি এতই ভালোবাসো তাহলে বিয়ের প্রস্তাব দাওনি কেন? আমার বাবা-মার সম্মুখীন হওনি কেন? হলে কি তোমার বাবা-মা তোমাকে আমার সঙ্গে বিয়ে দিত? আমি তো খেয়ে পড়ে তোমাদের বাড়ি মানুষ হয়েছি। হেনা বলে, না হয় আমাকে বলতে। তোমাকে বললে কী হতো? তুমি আমাকে নিয়ে কোথাও চলে যেতে পারতে! যেতে তুমি আমার সঙ্গে? তুমি বললেই আমি যেতাম। আমিও চেয়েছি তুমি আমার কাছে কিছু বলো? কিংবা যখন বিয়ে ঠিক হয় তখন আমার বাবা-মায়ের কাছে কিছু বলো। দেখি তুমি কিছু বললে না। তখন আমি কি করবো, বাবা মা যেখানে বিয়ে ঠিক করছে, আমি রাজি হয়ে গেলাম। তুহিন হেনাকে বাড়ির কাছাকাছি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে যায়। যাওয়ার সময় তুহিন এক দৃষ্টিতে হেনার দিকে তাকিয়ে থাকে। দু’জনার মনের মাঝে আলোড়িত হতে থাকে হাহাকারের বেদনা। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু। হেনা বাড়ি ঢুকে চুপচাপ হয়ে যায়।
সকালবেলা বাড়িতে কান্নার রোল। পুরো পাড়া পড়শী রাজিব হোসেনের বাড়ি। একি হলো? কীভাবে হলো? নানা জনের নানা প্রশ্ন। জানতে পারে হেনাকে সাপে কামড়েছে। ওঝা ডাকা হয়েছে। বাড়ির উঠানে হেনাকে রেখেছে কাপড় দিয়ে ঢেকে। ওঝা হেনার চতুর্দিকে রশি দিয়ে বাউন্ডারি দেয় যেন তার মধ্যে কেউ না ঢোকে। এরপর ওঝা ঝাড়ফুঁক শুরু করে। ওঝার ঝাড়ফুঁকে কোনো কাজ হয় না। হেনা ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। বাড়িতে কান্নার রোল পড়ে যায়। মেয়ের বিয়ে হতে না হতেই একী হলো! হাতে মেহেদির দাগ। খবর পেয়ে তুহিন আসে। সবার সঙ্গে তুহিনও হেনার দাফন কাফনে অংশ নেয়। তুহিন নিষ্ঠাবান প্রেমিকের মতো ভাবতে থাকে। হেনা বেঁচে থাকতো। ওর বদলে আমার মৃত্যু হতো। সাপ কেন আমাকে দেখলো না। সাপ কেন আমাকে কাটলো না। যে মানুষটার বিয়ে হলো তা আমি সহ্য করতে পারছিলাম না। তাকে না দেখে থাকতে পারছিলাম না। সেই মানুষটা দুনিয়ায় নেই এখন আমি কীভাবে থাকবো। এখন তো আর ভালো লাগছে না আমার এই প্রাণহীন পৃথিবী।

আজকালের খবর/আরইউ








সর্বশেষ সংবাদ
সংবিধানের বাইরে গিয়ে ভোট করার সুযোগ নেই: সিইসি
নেত্রকোণা-৪ আসনে মনোনয়নপত্র জমা দিলেন সাজ্জাদুল হাসান
পিটার হাসকে হত্যার হুমকি: ৮ জনের বিরুদ্ধে মামলার আবেদন
পদত্যাগ করা মন্ত্রীদের দায়িত্ব পেলেন যারা
জামিন পাননি মির্জা আব্বাস
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
রিজার্ভ এখন ১৬ বিলিয়নের নিচে
আইএমওর ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন বাংলাদেশি দূত
পোশাক রপ্তানি বন্ধে পাঁয়তারা করছে আমেরিকা-ইউরোপ : বাণিজ্যমন্ত্রী
পদত্যাগ না করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে পারবেন দলীয় এমপিরা: ইসি
মালয়েশিয়ায় ভবন ধসে ৩ বাংলাদেশি নিহত, নিখোঁজ ৪
Follow Us
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : গোলাম মোস্তফা || সম্পাদক : ফারুক আহমেদ তালুকদার
সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : হাউস নং ৩৯ (৫ম তলা), রোড নং ১৭/এ, ব্লক: ই, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮-০২-৪৮৮১১৮৩১-৪, বিজ্ঞাপন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৯, সার্কুলেশন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৮, ই-মেইল : বার্তা বিভাগ- [email protected] বিজ্ঞাপন- [email protected]
কপিরাইট © আজকালের খবর সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft