কাজী আবদুল ওদুদের একটি উক্তি ছিলো, ‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি যেখানে আরষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব।’ এই কালজয়ী উক্তিটির মধ্যে বেশ কয়েকটি তাৎপর্যপূর্ণ বার্তা রয়েছে। সেগুলো হলো জ্ঞান, বুদ্ধি এবং মুক্তি। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। তাই সহজাতভাবে সে কিছু জ্ঞান পেয়ে থাকে। আর অধিকাংশ জ্ঞান তাকে অর্জন করতে হয় বই পুস্তুক পড়ে এবং অভিজ্ঞতার মাধ্যমে। জ্ঞানের সাথে বুদ্ধির একটি গভীর যোগসূত্র রয়েছে। প্রাচীন দার্শনিক সক্রেটিস জ্ঞান লাভের জন্য নিজেকে জানতে বলেছেন। তিনি বলেছেন, নিজেকে জানো। জ্ঞান বুদ্ধির ভিত তৈরি করে। আর প্রকৃত জ্ঞান ও বুদ্ধি জগত, সৃষ্টি ও সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে অনন্য ভূমিকা পালন করে। জ্ঞান অর্জনের জন্য নানা উপায় বা পথ রয়েছে। এ পথগুলির মধ্যে সহজ এবং নির্ভরযোগ্য পথটি হল বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা। যে জাতি যত বেশি বই পড়ে সে জাতি ততো বেশি জ্ঞান গড়িমায় সমৃদ্ধ।
বিখ্যাত লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী ওমর খৈয়ামের একটি লেখার ভাবানুবাদ করেছিলেন ঠিক এমনভাবে, ‘রুটি, মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে, অনন্ত যৌবনা হয়ে থাকবে বই যদি সেটা তেমন বই হয়।’ বই পড়ার বহুমুখী উপকারিতা রয়েছে। একটি সভ্য সমাজ তৈরিতে বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই। আর এই বইয়ের প্রধান পাঠক হয়ে থাকে যুব সমাজ যারা পরবর্তীতে দেশের হাল ধরেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে বাংলাদেশে বই পড়া মানুষের সংখ্যা দিনে দিনে কমছে, অথচ সেটা বাড়ার কথা ছিল। যাহোক সে বিষয়ে আলোচনায় যাওয়ার পূর্বে বই পড়ার একটি বৈশ্বিক জরিপ এখানে দিতে চাই। আমাদের পাশের দেশ ভারত। বিপুল জনগোষ্ঠীর এক দেশ যেখানে রয়েছে বহুজাতিক সংস্কৃতির প্রচলন। ভারতীয়রা বিশ্বে এখন বই পড়ায় সবচেয়ে এগিয়ে আছে। এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার করে নেওয়া দরকার আর তাহলো ছাপাকৃত বই না ই বুক কোনটি আমরা বিবেচনায় নেবো। আমি এখানে ছাপাকৃত বই পড়ার অভ্যাস নিয়েই আলোচনা করবো। যাহোক ভারতীয়রা ছাপাকৃত বই পড়ার অভ্যাস ব্যাপকভাবে গড়ে তুলেছে এবং জরিপে উঠে এসেছে যে প্রতি সপ্তাহে একজন ভারতীয় কমপক্ষে ১১ ঘণ্টা বই পড়ে। এখানে বই বলতে বিভিন্ন ধরনের বইকে বুঝানো হচ্ছে। ভারত ছাড়াও চীন, থাইল্যান্ড এবং যুক্তরাষ্ট্রের লোকেরা ব্যাপকভাবে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলেছে। থাইল্যান্ডের জনগণ প্রতি সপ্তাহে প্রায় ১০ ঘণ্টা বই পড়ে। চীনারা প্রতি সপ্তাহে আট ঘণ্টা এবং মার্কিনীরা প্রতি সপ্তাহে প্রায় ছয় ঘণ্টা বই পড়ে থাকে।
২০২০ সালে সবচেয়ে বেশি বই ছেপেছে চীন (চার লাখ ৪০ হাজার)। এর পরেই রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র (তিন লাখ চার হাজার)। অনেকেই মনে করেন যে বাঙালিদের মধ্যে বই পড়ার প্রবণতা এমনিতেই কম তদুপরি বর্তমানে আরো কম। কিন্তু এর কোনো গবেষণাধর্মী পরিসংখ্যান নেই। কয়েকটি বেসরকারি জরিপে দেখা গেছে যে পূর্বের তুলনায় বর্তমানে বাংলাদেশের তরুণদের বই পড়ার অভ্যাস কমেছে। আর এর পিছনে রয়েছে নানাবিধ কারণ। একটা সময় ছিলো যখন পাড়া, মহল্লা, থানা, উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে ছোট আকারে হলেও পাঠাগার গড়ে তোলা হতো। শিশু কিশোরেরা বিকাল হলেই ছুটে যেতো এসকল পাঠাগারে এবং বিভিন্ন ধরনের বই ও পত্রিকা পড়তো। এর ফলে বই পড়ার একটি অভ্যাস গড়ে উঠতো কিশোর ও যুবকেদের মাঝে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে সেই ধরনের পাঠাগারের সংখ্যা এখন অনেক কমে এসেছে। যান্ত্রিক জীবনে মানুষের যেন বই পড়ার সময়টুকু নেই। অর্থের পিছে বেপরোয়া হয়ে ছুটছে মানুষ। কিন্তু বইয়ের পাতায় যে বিশাল গুপ্তধন লুকিয়ে আছে সেটা ভেবে দেখার ফুসরতটুকু যেন নেই। পূর্বে বই উপহার দেওয়া ছিলো অত্যন্ত সম্মানের। যে কোনো অনুষ্ঠানে বই উপহার দেওয়ার প্রচলন ছিলো। কিন্তু ভোগীয় সমাজের করাল গ্রাসে বই উপহার দেওয়ার সংস্কৃতি আজ ধরাশায়ী হয়ে যেন ধুঁকে ধুঁকে মরছে। উপহার হিসেবে বই এর বদলে শুরু হয়েছে নগদ টাকা বা অন্যান্য কিছু দেওয়ার সংস্কৃতি। বই এমন একটি শক্তি যার নিজের চোখ না থাকলে অন্যের চোখ খুলে দিতে এর যেন জুরি নেই।
পূর্বে বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় বই পড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হতো ঘনঘন। এর ফলে তরুণ কিশোরদের মধ্যে যে সুপ্ত মেধা লুকিয়ে থাকতো সেটা আলোর মুখ দেখার সুযোগ পেত। পূর্বে শিক্ষার্থীরা একে অপরকে বই উপহার দিতো। এমনকি বই ধার দিতো পড়ার জন্য। কোথায় গেলো সেই দিন। সারাদিনে একটি পত্রিকা পড়ার জন্য তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করতো কিশোর তরুনেরা। কোথায় আজ সেই আবেগ। তাহলে প্রযুক্তি কি সব আবেগকে গ্রাস করেছে? ডিজিটাল বাংলাদেশ বির্নিমাণে সরকার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আমরাও সেটি চাই। কিন্তু প্রযৃক্তির থাবায় ছাপা বই পড়ার অভ্যাস হারিয়ে যাক সেটা চাই না। অনেকে হয়তো বলবেন এখন শিশু-কিশোররা তো সহজেই অনলাইনে বই পত্রিকা পড়ে নিতে পারছে। হ্যাঁ তা পারছে। তবে কথায় আছে দুধের স্বাদ ঘোলে কি মিটে! না মিটে না। ছাপা বই পাঠককে যে আনন্দ আর তৃপ্তি দেয় অনলাইন তা পারে না। একটি ছাপা বই বা পত্রিকার সাথে পাঠকের যে দরদমাখা বন্ধন গড়ে উঠে তা অনলাইনে কখনোই সম্ভব নয়। অনলাইনে পাঠের অভ্যাস গড়ে তোলাকে মন্দ বলার সুযোগ নেই, কিন্তু এর ফলে তরুণ সমাজের অনলাইন আসক্তি বৃদ্ধি পেতে পারে যেটি বিভিন্ন ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। ইতোমধ্যে শিশু-কিশোরদের মোবাইল আসক্তি চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। ছাপাকৃত বই পড়ার সাথে নানা বিষয় জড়িত থাকে। যারা প্রকাশনা শিল্পের সাথে জড়িত তাদের রুটি-রোজগার হয় এই মাধ্যম দিয়ে। যারা পাঠাগার ব্যবসার সাথে জড়িত তাদের জীবিকা এর সাথে জড়িত। যারা কাগজ শিল্পের সাথে জড়িত তাদের জীবিকাও অনেকাংশে এর সাথে জড়িত।
ছাপা বইয়ের বিস্তার ঘটলে নতুন নতুন সৃষ্টিশীল লেখকের তৈরি হয়। পাঠক এবং লেখকের মধ্যে তৈরি হয় একটি আত্মিক বন্ধন যা সুশীল সমাজ নির্মাণে এক বিরাট হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। পূর্বে বাংলা একাডেমি কর্তৃক আয়োজিত বই মেলায় তিল ধারনের ঠাঁই থাকতো না। মনে হতো বই পড়ায় জোয়ার এসেছে। পাঠক, লেখক, প্রকাশকদের এক মহা মিলন মেলায় পরিণত হতো মেলার মাঠ। নতুন বইয়ের পৃষ্ঠার গন্ধ পাঠকে এক অনাবিল আনন্দের রাজ্যে নিয়ে যেতো। একটি বই ক্রয় করাকে পাঠক বড় গর্বের বিষয় মনে করতো। কোথায় গেলো সেসব দিন। এখন বই মেলায় তেমন বই বিক্রি হয় না। ছাপা বই যেন পাঠকের আকালে মরতে বসেছে। পাঠকশূন্য হয়ে পড়ছে এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠাগার গুলিও। শিক্ষা ব্যবস্থায় কোচিং বানিজ্য জেঁকে বসেছে। শিক্ষক, শিক্ষার্থী কাররই বই পড়ার সময় নেই। সবাই উম্মাদের মতো ছুটছে অর্থের পিছে। একটি সভ্য জাতি তৈরি হতে বহু বছর সময় লাগে। বই পড়ার অভ্যাস থেকে বিচ্যুতি আমাদের তরুণ প্রজন্মকে আজ এক ভয়ংকর সর্বনাশের দিকে নিয়ে যাছে। যাদের হাতে থাকার কথা নজরুল, রবীন্দ্রনাথের বই, তাদের হাতে আজ মাদকের বোতল আর তাদের পকেটে ইয়াবার প্যাকেট। বর্তমানে কিশোর গ্যাং তৈরি হচ্ছে দেশের নানা প্রান্তরে। এদের হাতে মরণঘাতি মাদক আর অস্ত্র দেখা যায়। অথচ এই কিশোরদের হাতে যদি একটি ভাল বই তুলে দেওয়া যেত তবে তারা হয়তো বিপথগামী হত না। সমাজে আজ নারী ধর্ষণ বেড়েছে ব্যাপকভাবে। শাস্তি দিয়ে এ ধরনের কর্মকাণ্ড বন্ধের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু এর শিকড়ে কি আমরা ঢুকতে পেরেছি। আজ যে সব যুবক এ ধরনের কাজ করছে তাদের হাতে কি আমরা বই তুলে দিতে পেরেছি? না আমরা তা পারছি না।
বর্তমানে তরুণ প্রজন্ম অনলাইনে হয়তো পাঠাভ্যাস গড়ে তুলছে কিন্তু অনলাইনে বই পাঠে কোনো প্রাণ নেই। পূর্বে একজন শিক্ষার্থী তার পড়ার টেবিলে কত বই আছে সেটির পরিসংখ্যান দিয়ে গর্ব করতো, আরো বেশি বই সংগ্রহের জন্য তার প্রচেষ্টা লেগে থাকতো। আর আজ সব পড়া যেন মোবাইল ফোন আর কম্পিউটারে বন্দি। পাঠকের নিজস্ব সংগ্রহ বলে কিছু নেই। বর্তমানে কবিতার বই পাঠকরা কিনতে চান না। অথচ কবিতা হচ্ছে উচ্চমার্গের একটি সাহিত্য। কেন এমন হচ্ছে? এটি নিয়ে কেন আমরা গবেষণার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি না? যুব সমাজকে এভাবেই কি আমরা ছেড়ে দেবো? আমাদের কি কোনো দায় নেই? তরুণ প্রজন্মকে ছাপা বই পাঠের অভ্যাসে অভ্যস্ত করতে রাষ্ট্রীয় এবং প্রাতিষ্ঠানিক পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। তরুণরা যেন বই পড়তে অনুপ্রানিত হয় সেজন্য প্রচার চালাতে হবে ব্যাপকভাবে। তরুণদের বই পড়ার ওপর ভিত্তি করে পুরষ্কৃত করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে শিক্ষকদের ভূমিকা সবচেয়ে বড়। পাঠ্য বইয়ের বাইরে অন্যান্য বই ও পত্রিকা যেন শিক্ষার্থীরা পড়ে সেটি তারা নিশ্চিত করবেন। অনেক সময় টাকার কারণে বই কিনে গরীব ছেলে মেয়েরা পড়তে পারে না। এক্ষেত্রে পাঠকদেরকে বই ধার দেওয়ার ব্যবস্থা করতে প্রাতিষ্ঠানিক এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে। একটি মুদ্রিত বই বা পত্রিকাকে একজন শিক্ষার্থী যেন সম্পদ ভবতে শিখে সেটিই নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমানে যে সামাজিক অবক্ষয় শুরু হয়েছে সেটি থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য শিক্ষার্থীদেরকে বইমুখী করতে হবে। শিশু কিশোরদের জন্য গড়ে তুলতে হবে পর্যাপ্ত পাঠাগার এবং উন্মুক্ত খেলার মাঠ। বই উপহার দেওয়ার সেই সংস্কৃতিকে আবার শক্তিশালী করতে হবে।
স্কুল, কলেজে বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। এসব অনুষ্ঠানে বিজয়ীদের মেডেলসহ নানা ধরনের পুরষ্কার দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বই উপহার নিশ্চিত করতে হবে অন্যান্য উপহারের পরিবর্তে। পাঠ্য বই পড়ার বাইরে অন্যান্য বই যারা পড়বে তাদের জন্য পরীক্ষায় কিছু নম্বরও ধার্য করা যেতে পারে। বেশি বেশি সংখ্যক বই মেলার আয়োজন করতে হবে। যে নৈতিক অবক্ষয় তরণ প্রজন্মকে গিলতে শুরু করেছে সেটি থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে তরুণদের মাঝে। প্রতিদিন অন্তত এক ঘণ্টা করে বই পড়ার কথা বলে থাকেন চিকিৎসকেরা। এটি একইসঙ্গে জ্ঞান-বুদ্ধি বৃদ্ধি করে এবং দেহ-মনকে চাঙ্গা রাখতে দারুণ ভূমিকা পালন করে। বর্তমানে হাত বাড়ালেই মিলছে মাদক। আর সর্বনাশী এই মাদক তরুণ প্রজন্মকে গ্রাস করছে। হাত বাড়ালেই তারা যেন হাতে একটি বই পায় সেটা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এ দেশের তরুণেরা বুকের তাজা রক্ত দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছিলো। প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তাদের ছিলো স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। আজ তবে যুবকেরা কেন বিপথগামী হবে? কিশোর-তরুণদের এটিই মাথায় ঢুকিয়ে দিতে হবে যে বই তাদের চলার পথে একটি উৎকৃষ্ট বন্ধু, যে বন্ধু কখনোই বেঈমানী করে না। বই হোক তরুণ প্রজন্মের সঙ্গী।
মাজহার মান্নান : সাহিত্যিক ও কলাম লেখক।
আজকালের খবর/আরইউ